যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির আলোচনা ভেস্তে যাবে, এবং কাতারের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটবে- এই আশঙ্কা থেকেই গুপ্তচর সংস্থাটি অপারেশন চালাতে রাজি হয়নি।
হতে সংগৃহীত
ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের হত্যায় পরিকল্পিত স্থল অভিযান চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছে।
এমন অভিযান যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির আলোচনা যেমন ভেস্তে দেবে তেমনি কাতারের সঙ্গে সম্পর্কেরও অবনতি ঘটাবে- এই আশঙ্কা থেকেই তারা দোহায় অপারেশন চালাতে রাজি হয়নি, শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
মোসাদ স্থল অভিযান না চালানোয় বাধ্য হয়েই গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ইসরায়েলকে বিমান হামলা চালাতে হয়েছে। তাদের লক্ষ্যই ছিল দোহায় জড়ো হওয়া হামাসের শীর্ষ নেতাদের হত্যা, কিন্তু বিমান হামলায় যে সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি, তা যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
টাইমস অব ইসরায়েল লিখেছে, হামলার পর প্রাথমিকভাবে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল যে কাতারে থাকা হামাসের নেতা খলিল আল-হায়া নিহত হয়েছেন। কিন্তু শুক্রবার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, খলিল তার ‘শহিদ’ সন্তান হাম্মামের শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছেন।
ইসরায়েলি হামলায় হাম্মামের নিহত হওয়ার খবর আগেই নিশ্চিত করেছিল তারা।
মঙ্গলবারের ওই হামলা কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর এই অভিযানের ব্যাপারে ইসরায়েলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধের খবর সামনে আসতে শুরু করে। বিশেষ করে হামলার ধরন এবং জিম্মি মুক্তির আলোচনা চলাকালেই কেন হামলা করতে হবে, তা নিয়ে।
যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি নিয়ে আলোচনা বিষয়ে অবগত এক ঊর্ধ্বতন ইসরায়েলি কর্মকর্তা চ্যানেল টুয়েলভকে বলেছেন, প্রতিরক্ষা কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ কর্মকর্তাই হামলাটি পিছিয়ে দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
“অবস্থান তো স্পষ্ট, জিম্মিদের ফেরানোর একটি প্রস্তাব টেবিলে রয়েছে, আর আলোচনা শেষ হওয়া পর্যন্ত তা চালিয়েই যেতে হবে। সবাই বুঝছিল এর ফল কী হতে যাচ্ছে, আর এই সময়ে এমন অভিযান ওই সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে পারে,” বলেছেন ওই কর্মকর্তা।
দোহায় হামলার ব্যাপারে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের চিফ অব স্টাফ এয়াল জামির, মোসাদপ্রধান দাভিদ বারনেয়া ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাখি হানেগবি আপত্তি জানিয়েছিলেন বলে চ্যানেল টুয়েলভের খবরে বলা হয়েছে।
হামলার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ, কৌশল বিষয়ক মন্ত্রী রোন দারমার ও অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান, যিনি ‘মেম’ নামে পরিচিত, এ চারজন।
জিম্মিদের বিপদে ফেলতে পারে এমন যে কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করবেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এমনটা ধরে নেওয়ায় জিম্মিমুক্তি সংক্রান্ত আলোচক দলের প্রধান নিৎজান আলনকে দোহায় অভিযান বিষয়ক ওই বৈঠকে ডাকাই হয়নি।
হামাস নেতাদের হত্যায় মোসাদ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে স্থল অভিযান চালানোর নানান ছক কষলেও দোহায় আলোচনার জন্য আসা খলিল ও অন্যদের ওপর হামলা চালাতে তারা অস্বীকৃতি জানায়, সে কারণে বাধ্য হয়েই ইসরায়েলকে বিমান হামলা চালাতে হয়, শুক্রবার ওয়াশিংটন পোস্টকে এমনটাই বলেছেন বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত দুই ইসরায়েলি।
দোহার সঙ্গে গুপ্তচর সংস্থাটির সম্পর্ক এবং হামাসের সঙ্গে আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা থাকায় মোসাদপ্রধান বারনেয়া কাতারে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীটির নেতাদের হত্যায় বিরোধিতা করেন, বলছে সূত্রগুলো।
ইসরায়েল পরে বিমান হামলার ঘোষণা দিয়ে জানায়, গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের সহযোগিতায় বিমান বাহিনী দোহায় হামলা পরিচালনা করেছে। অভিযানটি তত্ত্বাবধান করাও হয়েছে শিন বেতের একটি কমান্ড সেন্টার থেকে।
শিন বেত সাধারণত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বে থাকে, ইসরায়েলের বাইরে অভিযানের দায়িত্ব থাকে মোসাদের হাতে।
ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদই তেহরানে গত বছর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করেছিল। চলতি বছর ইরানে ইসরায়েলের আচমকা হামলা এবং হাজারো হিজবুল্লাহ সদস্যের পেজার বিস্ফোরণ অভিযানেও তাদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
“এবার মোসাদ স্থলে এই অভিযান চালাতে অনিচ্ছুক ছিল,” এক ইসরায়েলি ওয়াশিংটন পোস্টকে এমনটাই বলেছেন। কেননা, সংস্থাটি হামাসের সঙ্গে আলোচনায় কাতারকে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী বিবেচনা করে।
নেতানিয়াহু হামলার যে সময় নির্ধারণ করেন, তাতে মোসাদের ভিন্নমত বিষয়ে অবগত আরেক ইসরায়েলি বলেন, “আমরা তাদেরকে এখন থেকে এক, দুই বা চার বছর পরেও মারতে পারতাম, মোসাদ জানে কীভাবে করতে হবে। কিন্তু এখন কেন?”
এসব বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট যোগাযোগ করেও মোসাদের মন্তব্য পায়নি। মোসাদের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
শুক্রবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেদিনের হামলায় ইসরায়েল লোহিত সাগরের ওপর বিমান থেকে দোহার লক্ষ্যবস্তুতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে।
এ সম্বন্ধে অবগত ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে খবরের কাগজটি জানায়, অভিযানটি এমনভাবে চালানো হয়েছে যেন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানকে সৌদি আকাশসীমায় ঢুকতে না হয়। এটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করারও লক্ষ্য ছিল যেন যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি জানানোর জন্য সময় কম পায়।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মঙ্গলবারের অভিযানে ইসরায়েলি ৮টি এফ-১৫ ও চারটি এফ-৩৫ অংশ নেয়। এ যুদ্ধবিমানগুলো ইসরায়েলের দক্ষিণ থেকে লোহিত সাগরের ওপর এসে আরব উপসাগরের অপরদিকে কাতার লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।
হামলা শুরুর কয়েক মিনিট আগ পর্যন্তও ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি, তাদের নিশানা কী তাও জানায়নি তারা। মহাকাশভিত্তিক সেন্সরে ক্ষেপণাস্ত্রের তাপ শনাক্ত করার পর যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত হয় যে তেল আবিব কাতারের রাজধানীতেই হামলা করছে। কিন্তু ওয়াশিংটন যতক্ষণে কাতারকে সতর্ক করে, তারও ১০ মিনিট আগেই ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে।
“ক্ষেপণাস্ত্র মারার কয়েক মুহূর্ত আগে এমনভাবে নোটিস দেয়া হয়েছিল যেন হামলার আদেশ আটকে দেওয়া বা বন্ধ করা না যায়,” এমনটাই বলেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি ইসরায়েলের এ হামলাকে ‘পুরোপুরি অবিশ্বাস্য’ আখ্যা দিয়েছেন বলেও জানিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
দোহায় ইসরায়েলের ওই হামলা এরই মধ্যে আরব অঞ্চলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্রই এ হামলার নিন্দা জানিয়ে কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তেল আবিবের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ডনাল্ড ট্রাম্পের আব্রাহাম চুক্তিও এ হামলায় ঝুঁকির মুখে পড়ল, বলছেন অনেক বিশ্লেষক।