ডাকসু ও জাকসুর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনেও সংগঠনটির প্রার্থীদের ধারেকাছে ছিল না কেউ; কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদের ২৪টিই তাদের।
হতে সংগৃহিত
শান্তিপূর্ণ ভোট শেষে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেল ইসলামী শিবির।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর হওয়া এই ভোটের মাধ্যমে দেশের তিনটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নেতৃত্ব গেল সংগঠনটির হাতে; ৪৪ বছর পর প্রত্যাবর্তন ঘটল চাকসুতে।
বুধবার ভোট শেষের ১২ ঘণ্টা পর ভোর পৌনে ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের জনাকীর্ণ মিলনায়তনে ফল ঘোষণার সময় উল্লাস আর স্লোগানে জয় উদযাপন করলেন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা।
বড় ধরনের শোরগোল ছাড়া শেষ হওয়া ভোটের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন সেখানে একে একে জয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। তখন ভিপি ও জিএসসহ কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতেই উঠে আসে শিবির ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীদের নাম।
নগরী থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার ৫১৬ ভোটারের মধ্যে ৬৫ শতাংশের ভোট দেওয়ার তথ্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
নতুন সময়ের এই ‘প্রথম ভোটাররা’ প্রায় তিন যুগ পর চাকসুতে নাজিম উদ্দিন ও আজিম উদ্দিন আহমেদের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিলেন ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে।
ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ভিপি হিসেবে বিপুল ব্যবধানে জয় পেলেন ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইব্রাহীম হোসেন রনি; যিনি চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য। তিনি পেয়েছেন ৭,৯৮৩ ভোট। তার প্রতিদ্ব্ন্দী
ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় ভোট পেয়েছেন ৪,৩৭৪টি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ মিলনায়তনে চাকসু নির্বাচনের ফলের অপেক্ষা।
জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন ইতিহাস বিভাগেরই ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাঈদ বিন হাবিব। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের এই সাহিত্য ও মানবাধিকার সম্পাদক পেয়েছেন ৮,০৩১ ভোট। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন ছাত্রদলের মো. শাফায়াত হোসেন; পেয়েছেন ২,৭২৪ ভোট।
শীর্ষ এ দুই পদে বিপুল ব্যবধানে জয় পেলেও শিবিরের হাতছাড়া হয়েছে এজিএস পদ; যেখানে জয় পেয়েছেন ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক। তিনি পেয়েছেন ৭,০১৪ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের সাজ্জাত হোছন মুন্না পান ৫,০৪৫ ভোট।
এর বাইরে সহ-খেলাধূলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন তামান্না মাহফুজ স্মৃতি; যিনি ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী হয়ে ভোটে ছিলেন।
এজিএস পদে জয়ী ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক।
গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বাস্তবতা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগবিহীন এবারের চাকসু নির্বাচনের প্রচারের সময় মূল লড়াইটা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের মধ্যে হওয়ার আভাস থাকলেও বাস্তবে ফারাক ছিল অনেক বেশি।
যদিও পাঁচটি কেন্দ্রে গণনা শেষে প্রাথমিক ফল প্রকাশের শুরুর দিকে দুই-তিনটি হলের ফলাফলে ছাত্রদলের ভিপি-জিএস প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিলেও সময় যত গড়িয়েছে ভোটের লড়াই থেকে ততই পিছিয়ে গেছে তাদের প্রার্থীরা। অন্য ১১টি প্যানেলের প্রার্থীদের কেউও শিবিরের প্রার্থীদের ধারে কাছে ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের মত এখানেও জয়ের ধারা বহাল রাখল শিবির।
এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব গেল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাতে। ৪৪ বছর পর চাকসুতে প্রত্যাবর্তন ঘটল সংগঠনটির, যারা আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলের বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যেই আসতে পারেনি।
আর ১৯৯০ সালের সবশেষ নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্যানেল থেকে এজিএস পদে জয়লাভ করা ছাত্রদল এবার এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে জেতার লড়াইয়ে নামলেও সফল হতে পারেনি। সেবারের মত এবারও শুধু এজিএস পদই পেয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভোট গণনার সময় গানের আসর বসিয়ে ফলের অপেক্ষা।
ডাকসু ও জাকসুর মত চাকসুর ভোট নিয়েও অভিযোগের তীর ছুঁড়েছে ছাত্রদল। তবে ভোটের পরপরই আগের দুই ক্যাম্পাসে নির্বাচন বর্জন করলেও চাকসুতে তা করেনি বিএনপির ছাত্র সংগঠনটি। যদিও গণনা শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে অনিয়মের অভিযোগ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার দাবি তুলেছেন তাদের প্যানেলের প্রার্থীরা।
এছাড়া চাকসুতে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল ফল ঘোষণাতেও। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে ফল দিতে দীর্ঘ সময় লাগলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফলাফল মিলেছে দিনের আলো ফোটার আগেই।
ডাকসু ও জাকসুর ফল গণনা তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এখানে দ্রুত ফল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
অন্য দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এক ঘণ্টা পরে সকাল ৯টা থেকে শুরু হওয়া ভোট শেষ হয় বিকাল ৪টার কিছু সময় পর। পাঁচটি কেন্দ্রে মেশিনে ভোট গণনা করা হয়। নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভোট গণনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সেলের প্রোগ্রামাররা তা আবার আলাদাভাবে গণনা করেন। দুটি ফল মিলে যাওয়ার পর ভোটের ফল প্রকাশ করার কথা আগেই বলেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
ভোট গ্রহণ শেষের ১২ ঘণ্টা পর বুধবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ মিলনায়তনে চাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন ফল ঘোষণা করেন।
ফল ঘোষণা করতে কতক্ষণ লাগবে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন দুপুরে বলেছিলেন, “শতভাগ স্বচ্ছভাবে ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণার জন্য ‘যৌক্তিক’ সময় যেটুকু লাগে সেসময় দিতে হবে।
এদিন সকালে ভোট শুরু হয় শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে। সকালে শাটল ট্রেন ও ভোটের জন্য দেওয়া বিশেষ বাসে চড়ে নগরী থেকে ক্যাম্পাসে আসেন ছাত্রছাত্রীরা। সঙ্গে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে থাকা শিক্ষার্থীরা।
সকাল ৯টার সময় ভোটগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও ভোটগ্রহণ শুরু হতে বিলম্ব হয় আধা ঘণ্টা; আর দৃষ্টিহীনদের আরও বিলম্বে বেলা সাড়ে ১১টায় ভোট নেওয়া শুরু হয়।
তবে ভোট শুরুর পরপরই ভোটারদের চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহৃত কালি অমোচনীয় নয় বলে অভিযোগ আসতে শুরু করে। এছাড়া ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ নিয়ে অভিযোগ করে ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা।
ভোট শুরুর পর জানা যায় আইটি ফ্যাকল্টিতে ব্যালট বক্সে স্বাক্ষর ছাড়া ১২টি ব্যালট পাওয়ার তথ্যও।
শিক্ষার্থীদের মত এ নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ্বসিত উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারও। সকাল ১০টার দিকে কয়েকটি ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের বলেন, “এটা জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরির এবং রিহার্সাল হিসেবে বিবেচিত হবে।”
মধ্যরাতে অবরুদ্ধ উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মো. কামাল উদ্দিন।
এবারের চাকসু নির্বাচনে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে ১৩টি প্যানেলে ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ভিপি, জিএসসহ কেন্দ্রীয় সংসদে ২৬টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৪১৫ জন। এর মধ্যে পুরষ ৩৪৮ এবং নারী ৪৭ জন। তবে শিবিরের সঙ্গে ছাত্রদল ছাড়া অন্য কোনো প্যানেলের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বীতাই গড়ে তুলতে পারেনি।
অপরদিকে ১৪টি হল ও একটি হোস্টেলের সংসদ নির্বাচনে ২০৬ পদে প্রার্থী ছিলেন ৪৯৩ জন। নয়টি ছাত্র হলে মোট প্রার্থী ৩৫০ জন, পাঁচ ছাত্রী হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১২৩ জন।
ভোট শেষে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ছাত্রদল নেতারা।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনেক প্রথমের চাকসু নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের মত ছিল স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ভোটারের ছবিসহ নম্বর আর ওএমআর মেশিনে ভোট গণনাও ছিল প্রথম। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদর্শনের ব্যবস্থাও করে প্রশাসন। তবে কোথাও কোথাও এলইডি মেশিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা নিয়ে পরে প্রশ্ন তোলে ছাত্রদল ও শিবির।
ভোট দিচ্ছেন এক শিক্ষার্থী।
এছাড়া অভিযোগ ছিল অমোচনীয় কালি নিয়েও। বহিরাগত প্রবেশ নিয়েও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয়।
নির্বাচনকে সামনে রেখে দিন কয়েক ধরেই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল পাহাড় ঘেরা এ ক্যাম্পাসে। ভোট শেষে ফল গণনার আগে ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে উত্তেজনার খবরের মধ্যে মোতায়েন করা হয় বর্ডার গাড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদেরও।
আগের বিজয়ী যারা
পাহাড় ঘেরা ক্যাম্পাসে ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে; আর সবশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে।
• ১৯৭০ সালের প্রথম চাকসু নির্বাচনে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও আবদুর রব। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন চাকসু জিএস আবদুর রব।
• ১৯৭২ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না জিএস নির্বাচিত হন।
• ১৯৭৪ সালে তৃতীয় নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক ভিপি এবং গোলাম জিলানী চৌধুরী জিএস নির্বাচিত হন।
• ১৯৭৯ সালে চতুর্থ নির্বাচনে ভিপি হন জাসদ ছাত্রলীগের মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী এবং জিএস হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী।
• ১৯৮১ সালে পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি ও জিএস হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার।
• ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী জাতীয় ছাত্রলীগের নাজিম উদ্দিন ভিপি নির্বাচিত হন। জিএস হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ।