নেতৃত্বের হিস্যা নিয়েই মূলত একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
হতে সংগৃহিত
আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মিল থাকায় তরুণদের দুটি দল-গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ‘একীভূত’ হচ্ছে, এমন আলোচনার মধ্যে বিকল্প চিন্তাভাবনার কথাও জানা যাচ্ছে। তাহলে কী দুই দলের একীভূতকরণ ঝুলে গেল?
এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একীভূত দলের নেতৃত্বে কার কী অবস্থান হবে, সেই বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করা যাচ্ছে না। নেতৃত্বের হিস্যা নিয়েই মূলত একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একীভূত হওয়ার বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে আছে। বিকল্প অন্য কোনো উপায়ে একসাথে পথ চলা যায় কি না, সেই বিষয়টিও দুই দলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।”
দল দুটির একীভূতকরণের খবরটি গণমাধ্যমে আসে গত সপ্তাহে।

অভ্যুত্থানের পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তুলে ধরে আত্মপ্রকাশ করে এনসিপি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় গণঅধিকারের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর আহত হওয়ার পর দুই দলের নেতাদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
পরে একীভূত হওয়ার জন্য দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ১৫ জন প্রতিনিধি বসে কয়েক দফায় আলোচনাও করেছিলেন।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন একীভূত হওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে দুই দলের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা একীভূত হওয়া যতটা সহজ ভেবেছিলেন, বিষয়টি ততটাই কঠিন বলে মনে করছেন এখন। তাই একীভূত হওয়ার বিকল্প হিসেবে জোটবদ্ধ আন্দোলন কিংবা বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনের চিন্তা করছেন শীর্ষ নেতারা।
জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক মো. আবু হানিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে আদর্শগত ও কর্মসূচিগত অনেক মিল রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি), জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন ও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে আমাদের কর্মসূচি একই। সেই কারণে একীভূতকরণের আলাপটি উঠেছিল।
“একীভূতকরণ বেশ জটিল প্রক্রিয়া বিধায়, আমরা বিকল্প চিন্তাও করছি। আগামী দিনে কীভাবে একসঙ্গে পথ চলা যায়, সেই ধরনের একটা প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেটা একীভূতকরণও হতে পারে, আবার জোটবদ্ধ বা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনও হতে পারে।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংসদ ভবনে জনতার ঢল।
কোটা আন্দোলন, দুই দলের উত্থান
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদে থাকা নেতাদের একাংশ সেই একই দাবিতে গত বছর আন্দোলনে নামে, যারা ধারাবাহিকতায় অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থান দেখল বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর সমাজসেবা সম্পাদক পদে জিতেছিলেন আখতার হোসেন, তিনি এখন এনসিপির সদস্য সচিব। এ দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংস্কৃতি সম্পাদক পদে এবং আকরাম হোসেন সাহিত্য সম্পাদক পদে একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছিলেন।
বাংলাদেশে মোদীর সফরবিরোধী আন্দোলন এবং বিভিন্ন ধরনের ভারতবিরোধী কর্মসূচির আন্দোলনে থাকা এই তরুণরা আলাদা হয়ে যান এক সময়।
আখতার হোসেনের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ, তারাই প্রথমে ছাত্র শক্তি নামে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামেন তারা।
এ আন্দোলেনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকাররকে ক্ষমতাচ্যুত করে তরুণ এই নেতৃত্ব।
এই অভ্যুত্থানে গর্ভ থেকে এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে সেই ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দলটি চলতি মাসেই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
এক সময়কার ছাত্র অধিকার পরিষদের শীর্ষনেতা নুরুল হক নুরও পরবর্তীতে ২০২১ সালে রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ গঠন করেন।
অভ্যুত্থানের মাঠে থাকা এই দলটি অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর গত বছরের ৩১ অগাস্ট ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ আখ্যায়িত করে গত বছরের অক্টোবর মাসে জাতীয় পার্টি কার্যালয়ে আগুন দেয় একদল লোক।
ভাঙন ও চড়াই উৎরাই পার করা এ দলটি জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতে সোচ্চার। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে কয়েক দফা বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে জড়িয়েছে দলটি।
এনসিপির হাসনাত আব্দুল্লাহ ডাকে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অবস্থান কর্মসূচির জেরে গেল মে মাসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আসে।
রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দুই দলের অবস্থান কাছাকাছি।
এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে এনসিপির আরেকটি বলয় তৈরির উদ্যোগ রয়েছে বলে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন।
রাজনীতির এমন নানা ঘটনাপ্রবাহে এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের পরিষদের একীভূত হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের ভেতরে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। দুই দলের শীর্ষ নেতারা এক হওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। আদর্শিকভাবে মিল রয়েছে, পারস্পরিক বোঝাপড়া হয়েছে।”
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে বাম প্রগতিশীল জোটের প্যানেল থেকে সমাজসেবা সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বর্তমানে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন।
সোমবার নির্বাচন কমিশনে যাওয়া এই এনসিপি নেতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, গণঅধিকার পরিষদ এনসিপির সঙ্গে একীভূত হচ্ছে কি না? জবাবে নাসীরুদ্দীন বলেন, “(হ্যাঁ) কথাবার্তা চলছে; আমরা সম্মত হয়েছি। কী প্রক্রিয়ায় আসবে, এটা পলিসিগত জায়গা। আদর্শগত বিষয় স্পষ্ট করেছি। কয়েকটা আসন বা দেনাপাওনার বিষয় না; আদর্শিক লড়াই রয়েছে।”

গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে রোরবার আলোচনা চলার কথা বলেন এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
তাহলে বাধা কোথায়?
২১৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর অল্প সময়ে তা আরও বিস্তৃত করে এনসিপি। শ্রমিক, আইনজীবী, পেশাজীবী, যুবশক্তি, প্রাবসী শাখাসহ বিভিন্ন শাখা চালু করেছে এনসিপি।
গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যাও ২৫০ জনেরও বেশি।
বর্তমানে এনসিপির গঠন কাঠামোতে ১০ সদস্যের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিল’ রয়েছে। এর সদস্যরা হলেন- নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, নাসিরউদ্দীন পাটওয়ারী, সামান্তা শারমিন, তাসনিম জারা, নাহিদা সারওয়ার নিভা ও আব্দুল হান্নান মাসউদ।
এর বাইরে এনসিপিতে ৫১ সদস্যের একটি নির্বাহী কাউন্সিল রয়েছে।
এনসিপির নির্বাহী কাউন্সিলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণঅধিকার পরিষদের কয়েকজন শীর্ষ নেতার জন্য এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ কয়েকটি পদ ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছিলেন তারা।
কিন্তু ইতোমধ্যেই গণঅধিকার পরিষদে নেতৃত্বের একাধিক স্তর তৈরি হয়েছে। এসব স্তরকে জায়গা দিতে গেলে বেশ জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সে কারণে দুই দলের ভেতর থেকেই একীভূত হওয়ার চেয়ে যুগপৎ আন্দোলনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গণঅধিকারের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন রোববার বলেছিলেন, “তিন দিন আগে দুই পক্ষের অন্তত ১৫ জন শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছি।”
তবে মঙ্গলবার এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলেন, একীভূত হওয়ার আলোচনা প্রায় থেমে গেছে। এখন বিকল্প কোনো উপায়ে একসাথে রাজনীতি করা যায় কিনা সেই দাবি জোরদার হচ্ছে।