“এটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে কী রাজনৈতিক জোট হবে? নাকি আসন সমঝোতা হবে এগুলো চূড়ান্ত হয়নি,” বলেন সাইফুল হক।
সংগৃহিত
গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা ঝুলে যাওয়ার পর জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ নয়টি দল নিয়ে ভোট কেন্দ্রিক জোট গঠনের আলোচনা সামনে এসেছে।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বলয়ের বাইরে তাদের এই আলাদা জোট হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিদ্যমান দুই বলয়ে এনসিপি যাচ্ছে না। এনসিপির নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি নিজস্ব রাজনীতি দাঁড় করানো, সংগঠন শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্তকরণ এখন এনসিপির সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
অন্য দুটি বলয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভোটটা টানতে চাচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে। জামায়াতের কাছ থেকে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হচ্ছে জুলাই সনদ ও বিচার সংস্কারের বিষয়ে এক ধরনের ঢিমেতাল। তারা জুলাইয়ের স্পিরিট, বিচার সংস্কারের চেয়ে এখন নির্বাচনের দিকেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে।”
সামান্তা শারমিন বলছেন, ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র, গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন সংবিধানের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তিতর্ক তুলে ধরছে এনসিপি।
রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ে এনসিপির কাছাকাছি গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ পার্টি বা এবি পার্টি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও জেএসডির (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) অবস্থান।
এ দলগুলো জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন, সনদের আইনি ভিত্তি ও সংবিধান সংস্কারে সাংবিধানিক সভা চায়।
অপরদিকে উচ্চকক্ষে পিআর চায় না বিএনপি। দলটি পরবর্তী সংসদে সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে। জামায়াত সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। এনসিপি ও জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আগে সংস্কার কার্যকরের দাবি জানিয়ে আসছে।
জাতীয় ঐকমত্যের সংলাপে বিএনপির অবস্থানে সঙ্গে মিল না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের সঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতির জোনায়েদ সাকিকে যথাক্রমে বগুড়া ও ঢাকার দুটি সংসদীয় এলাকায় কাজ করতে সহায়তার জন্য ‘বিশেষ চিঠি’ দিয়েছিল গত বছর। লক্ষ্মীপুরের একটি আসনের জন্য একই চিঠি পেয়েছিলেন জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব।
এছাড়া পটুয়াখালী ও ঝিনাইদহের দুটি আসনে যথাক্রমে গণঅধিকারের নুরুল হক নুর ও রাশেদ খানকে সহায়তার জন্য বিএনপি চিঠি দিয়েছিল।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে সরকার।
নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণার পাশাপাশি সমমনাদের কয়েকজন জাতীয় নেতাকেও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি।
গণতন্ত্র মঞ্চের কাছে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা চেয়েছে বিএনপি।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সারাদেশে নিজেদের প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলেও দলটি চাচ্ছে সমমনা ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট করতে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির সমন্বয়কদের গড়ে উঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি নেতারা চাচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি জোট গড়ে উঠুক।
যে দলটির দাবির মুখে জুলাই সনদ সই হচ্ছে, জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি ‘স্পষ্ট’ না হওয়ার যুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছে দলটি।
তবে তাদের সম্ভাব্য জোটের শরিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এ অবস্থায় জোট গঠন প্রক্রিয়া হোঁচটা খাবে কি না? এমন প্রশ্ন আসছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গত বছরের জুলাই মাসে শুরু হওয়া আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যার ধারবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদে থাকা নেতাদের একাংশ সেই একই দাবিতে গত বছর আন্দোলনে নামে, যারা ধারাবাহিকতায় অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থান দেখল বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর সমাজসেবা সম্পাদক পদে জিতেছিলেন আখতার হোসেন, তিনি এখন এনসিপির সদস্য সচিব। এ দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংস্কৃতি সম্পাদক পদে এবং আকরাম হোসেন সাহিত্য সম্পাদক পদে একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছিলেন।
বাংলাদেশে মোদীর সফরবিরোধী আন্দোলন এবং বিভিন্ন ধরনের ভারতবিরোধী কর্মসূচির আন্দোলনে থাকা এই তরুণরা আলাদা হয়ে যান এক সময়।
আখতার হোসেনের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ, তারাই প্রথমে ছাত্র শক্তি নামে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামেন তারা।
এ আন্দোলেনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকাররকে ক্ষমতাচ্যুত করে তরুণ এই নেতৃত্ব।
এই অভ্যুত্থানে গর্ভ থেকে এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে সেই ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
এক সময়কার ছাত্র অধিকার পরিষদের শীর্ষনেতা নুরুল হক নুরও পরবর্তীতে ২০২১ সালে রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ গঠন করেন।
আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মিল থাকায় তরুণদের দুটি দল-গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ‘একীভূত’ হওয়ার আলোচনা সামনে আসে।
তবে একীভূত দলের নেতৃত্বে কার কী অবস্থান হবে, সেই বিষয়ে মতপার্থক্য দূর না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সে আলোচনা ঝুলে যায়।
তারপরেই সামনে আসে নয় দলের মধ্যবর্তী জোট গঠনের প্রক্রিয়াটি। এনসিপি নেতারা নিজেদের মধ্যে দুই বলয়ে গেলে লাভ-ক্ষতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করেছে, সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও এসেছে। তাদের কেউ কেউ জামায়াতের সঙ্গে জোট করার পক্ষে মত দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে যাওয়ার কথা বলেছেন। তবে এনসিপি নেতৃত্বের বড় অংশ আলাদা জোট করে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলেছেন।
এনসিপির আরেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বয়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী জোট গঠনের প্রচেষ্টা তারা চালাচ্ছেন।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনী জোট গঠনের সম্ভাব্যতা বুঝতে আমরা ৯টি দল আলোচনায় বসেছিলাম। কীভাবে জুলাই জাতীয় সনদের আইনগত ভিত্তি দেওয়া যায়, রাষ্ট্র সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে করা যায় এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সেখানে একসাথে রাজনীতি ও নির্বাচন করার সুযোগ আছে কিনা সেই বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।”
গত সেপ্টেম্বর থেকে চলতি অক্টোবরের মধ্যে গণতন্ত্রণ মঞ্চ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপির মধ্যে তিনটি বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে জামায়াতসহ ছয়টি দল পাঁচটি অভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামে, এ আন্দোলনে এনসিপি ও এবি পার্টি থাকবে, এমন খবর সংবাদ মাধ্যমে আসে।
এ ধরনের আন্দোলনে থাকছে না, এনসিপির তরফে এ বক্তব্য আসে। এবি পার্টিকে যুগপৎ আন্দোলনে পায়নি জামায়াত। তারপরেই নয় দলের জোট গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারে গণ সংহতিসহ ছয়টি দল বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ছিলাম। সেই হিসেবে তাদের সঙ্গে আমাদের একটা রাজনৈতিক উঠাবসা, বোঝাপড়া রয়েছে। সেই হিসেবে বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোটের নির্বাচন কেন্দ্রিক বোঝাপড়া রয়েছে।
“পাশাপাশি আমরা বিএনপির বাইরেও সমমনা কিছু দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছি। তবে কোনো বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। আলোচনা আরও চলবে এবং সিদ্ধান্ত আসতে আরও সময় লাগবে।”
এদিকে গেল মাসের শেষের দিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত বলয়ের বিরোধে সনদ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সে সময় নির্বাচন যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে সে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতার জন্য নয় দল একসঙ্গে বসেছে বলে খবর আসে। এ দলগুলো বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নেওয়ার কথাও শোনা যায়।
কিন্তু জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা দূর হয়নি। এ অবস্থায় এনসিপি বাদে বাকি দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণতন্ত্র মঞ্চ গত সাড়ে তিন বছর বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ ধারায় আন্দোলনের মধ্যে ছিলাম। এখন আন্দোলন নাই, কিন্তু বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের একটা সাধারণ বোঝাপড়া আছে।
“নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে আমরা নিশ্চয় বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়াটা অগ্রাধিকার দেব। পাশাপাশি অপরাপর গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করবো। এটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে কী রাজনৈতিক জোট হবে? নাকি আসন সমঝোতা হবে এগুলো চূড়ান্ত হয়নি। পরবর্তীকালে এগুলো চূড়ান্ত হবে।”
সনদ স্বাক্ষর নিয়ে জোটের আলোচনা ব্যাহত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জোট যেহেতু আকার নেয়নি, তাই এখনই এ নিয়ে বলার কিছু নেই। তবে এটা একটা বিবেচনার প্রশ্ন। আবার ওদের এখনও স্বাক্ষরের সময় আছে। নিশ্চিয় তারা বিবেচনা করবে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তখন সিদ্ধান্ত নেব।”
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব মনে করেন, সনদে সাক্ষর না করায় জোট নিয়ে চলমান আলোচনায় প্রভাব পড়বে না।
“এটা জোট আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। আর সনদে সাক্ষরের সময়ও শেষ হয়ে যায়নি।”