হাজার কোটি টাকা না কি ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার।
হতে সংগ্রহিত
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গণভোটের প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্যের পর এখন তা কখন হবে সেই আলোচনা ডালপালা মেলেছে। এরমধ্যে এ ভোটের জন্য কত ব্যয় করতে হবে সরকারকে সেই বিশ্লেষণও সামনে আসছে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট আয়োজনের দাবি যেমন এসেছে, তেমনি এর আগে করার দাবিও এসেছে দলগুলোর তরফে।
আগের সব গণভোটের উদাহরণের ভিত্তিতে একজন বিশ্লেষক প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে করলে এজন্য অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হতে পারে। অন্যদিকে পৃথক সময়ে গণভোট আয়োজন করতে সংসদ নির্বাচনের ব্যয়ের প্রায় কাছাকাছি দুই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে।
সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয় প্রায় ২০০০ কোটি টাকা। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনে এবার এর চেয়ে বেশি ব্যয় বরাদ্দ রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোটে দায়িত্ব পালন করেন। এ দুই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের মতোই গণভোটের প্রস্তুতি নিতে হয়। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র, ভোটকক্ষ স্থাপন, ব্যালট বাক্স, নির্বাচনি সামগ্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য সমানই প্রয়োজন হয়।
গণভোটে শুধু ব্যালট পেপারে ভিন্নতা, প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের বিষয় আলাদা থাকে। ভোটার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায়ও ব্যয় বাড়ে বলে তুলে ধরেন তিনি।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ২৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
আর ছয় মাস পরে দেশের তৃতীয় গণভোটের ব্যয় কত হয়েছিল প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি। তবে ৬ কোটি ২১ লাখের বেশি ভোটারের গণভোটে অন্তত ভোটার সংখ্যার সমান ব্যয় হয়েছিল।
সবশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৯২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ব্যয়ের বড় অংশ যায় আইনশৃঙ্খলা খাতে।
কোন গণভোটে কত ব্যয়
অতীতে ফিরলে দেখা যায়, দেশে প্রথম গণভোট হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি জাতির আস্থা যাচাইয়ে সেই ভোট হয়।
ইসির তৎকালীন গণভোট প্রতিবেদনে (১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই সিইসি ও ইসি স্বাক্ষরিত) দেখা যায়, ওই গণভোটে ২ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
এর চার বছর আগে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, যাতে ব্যয় হয়েছিল ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
এরপর ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি আস্থা ও নির্বাচন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকাতে সম্মতি আছে কি না তা যাচাইয়ে দেশের দ্বিতীয় গণভোট হয়।
এতে তৎকালীন ইসির ব্যয় হয় ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সামরিক শাসনামলের এ গণভোটের ব্যয় দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কম হলেও তৃতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বেশি ছিল।
এর পরের বছর ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা।
আগের দুটি শামরিক শাসনামলে হলেও ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তৃতীয় গণভোট হয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে; দ্বাদশ সংবিধান সংশোধন বিলে সম্মতি রয়েছে কিনা এ প্রশ্নে।
গণভোট কবে? দলগুলোর দাবি কী?
সংসদ ও গণভোট একসঙ্গে করার বিষয়ে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি আলাদা সময়ে গণভোটের দাবিও উঠছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের মতামত জানতে জাতীয় নির্বাচনে ভোটের দিন আলাদা ব্যালটে ‘গণভোট’ চায় বিএনপি।
অপরদিকে জামায়াতের দাবি সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরেই তা করতে হবে। সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দলটির প্রতিনিধি দল বৈঠক করে এ সংক্রান্ত যুক্তি তুলে ধরেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে পৃথক ব্যালটে গণভোট দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার পক্ষেও মত এসেছে কয়েকটি দলের কাছ থেকে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আগামী নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে কি না তা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব দেবে ঐকমত্য কমিশন।
এদিকে এ নিয়ে এখনও সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় গণভোট নিয়ে কোনো প্রস্তুতি নেই এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসির।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত ও ইসির নির্দেশনা পাওয়ার পরই তারা গণভোট সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা ও সম্ভাব্য বাজেট বরাদ্দ নিয়ে কাজে হাতে দেবেন।
একজন নির্বাচন কমিশনার ব্যক্তিগত মত দিয়ে বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের বাইরে ‘গণভোট’ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এখন নির্বাচন কমিশনের নেই। তবে সরকার সিদ্ধান্ত দিলে ইসি তা বাস্তবায়নে কাজ করবে।
সংসদ ও গণভোট একসঙ্গে করার পক্ষে মত দিয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলী বলেন, এজন্য ইসির প্রস্তুতিটা নিখুঁত হতে হবে। আলাদাভাবে গণভোট করতে গেলে সংসদ নির্বাচনের প্রায় কাছাকাছি ব্যয় হবে। বেশিরভাগ ব্যয়তো আইনশৃঙ্খলা খাতেই যায়। শুধু ভোট দেওয়ার বিষয়টি আলাদা, কাজ তো সব একই।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, আর্থিক সাশ্রয়ের বিষয়টি চিন্তা করলে দেশের অর্থনৈতিক যে অবস্থা, তাতে পরপর দুটো নির্বাচন করলে জনগণের উপর একটা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে।
“একসঙ্গে করাটা সবচেয়ে ভালো। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ভালো একটা পরিকল্পনা করতে হবে। মানুষের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তারপর আইন-বিধিমালা তাড়াতাড়ি করতে হবে। হাতে তো সময় খুব কম।”
গণভোটেও কেন এত ব্যয়
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ১৯৭৭ সালে গণভোটের সময় ভোটার ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ। এতে ব্যয় ২ কোটি ৫ লাখ টাকা। ১৯৮৫ সালে ৪ কোটি ৮০ লাখ ভোটারের গণভোটে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা।
ইসির আনুষ্ঠানিক তথ্য না থাকায় ১৯৯১ সালে ৬ কোটি ২২ লাখ ভোটারের গণভোটে সাড়ে ৬ কোটি টাকার বেশি হয় বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
জাতীয় সংসদের সঙ্গে গণভোট করলে এবার মোট নির্বাচনি ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে মন্তব্য করে জেসমিন টুলীর ধারণা, অন্তত ৩০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হতে পারে।
তিনি বলেন, গণভোটের জন্য ব্যালট পেপারের কাগজ কেনা ও মুদ্রণ, ব্যালট বাক্স (হ্যাঁ ও না- দুটো বাক্স), অতিরিক্ত বাক্স দরকার হলে কিনতে হতে পারে; নির্বাচনের সামগ্রী অতিরিক্ত লাগবে, ভোটকক্ষ বাড়বে ও লোকবল বাড়বে। সংসদ ও গণভোট একসঙ্গে হলে সব প্রশিক্ষণ একসঙ্গে করা যেত এবং গণণা পদ্ধতি, ব্যালটে ভোট কীভাবে দেবে- সব কিছু চলে আসবে।
“জাতীয় সংসদের জন্য যত খরচ, তার ১০-১৫% যোগ করলে ব্যয় হয়ে যাওয়ার কথা। আলাদাভাবে গণভোট করতে হলে পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের জন্য এবং গণভোটের ব্যাপক প্রচারণা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ বড় ব্যয় লাগবে,” যোগ করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য।
১৯৯১ সালের তৃতীয় গণভোটের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, গণভোট করতে হলে বর্তমান ভোটকেন্দ্র ৪০ হাজার হলে ২ লাখ ৫০ হাজার অর্থাৎ আড়াই লক্ষ স্বচ্ছ ব্যালট বক্স ব্যবহার হবে। একইদিন গণভোট হলে দ্বিগুণ মোট ৫ লাখ ব্যালট বক্স প্রয়োজন হবে। পরবর্তী সময়ে এই অতিরিক্ত আড়াই লক্ষ স্বচ্ছ ব্যালট কোনো কাজেই লাগবে না। বরং সংরক্ষণে স্পেস লাগবে।
তিনি বলেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ব্যয় ২০% বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত খরচ হবে ফরম প্যাকেটের সিল তথা নির্বাচন মালামাল, ব্যালট পেপার মুদ্রণ ও অতিরিক্ত ১ কপি ছবিসহ ভোটার তালিকা ছাপাতে।
