প্রযুক্তি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর দুই পক্ষই একই প্রশ্ন করছে, তা হলো মেশিন যখন প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবদক্ষতা কোনগুলো।
সংগৃহিত
বিশ্বজুড়ে চাকরির বাজারে বড় পরিবর্তন আনছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। সম্প্রতি পরামর্শক কোম্পানি অ্যাকসেঞ্চার একদিকে ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে অন্যদিকে কর্মীদের এআই ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ফলে, যে প্রযুক্তি কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়াচ্ছে সেই প্রযুক্তিই আবার অনেকের চাকরি হারানোর কারণ হয়ে উঠছে।
শুধু অ্যাকসেঞ্চারই নয়, বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও একই পথে হাঁটছে। আইবিএম এরইমধ্যে শত শত পদ এআই সিস্টেম দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। তবে নতুনভাবে বিক্রয় ও বিপণন বিভাগে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে তারা।
অ্যামাজনও কিছু কর্মী ছাঁটাই করেছে কিন্তু এআই টুল তৈরি ও পরিচালনা করা টিমগুলোকে আরও বড় করছে। এতে স্পষ্ট বার্তা মেলে, এআইয়ের হাওয়ায় কিছু চাকরির ধরন বদলাচ্ছে, কিছু কাজ হারিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে কিছু নতুন কাজ তৈরি হচ্ছে।
প্রযুক্তি কীভাবে কর্মক্ষেত্রের ধরন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বদলে দিচ্ছে- এ বিষয়ে গবেষণা করছেন ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির লিবো কলেজ অফ বিজনেসের অধ্যাপক ও গবেষক মুরগানা আনন্দরাজান।
অধ্যাপক আনন্দরাজান বলছেন, এখনকার শিক্ষার্থীরা জানতে চায় কীভাবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নিজেদের চাকরি ধরে রাখতে পারবে। তারা জানতে চায় কীভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার নিরাপদ রাখা যায়।
অন্যদিকে, অনেক কর্পোরেট কর্মকর্তা জানতে চান কীভাবে কর্মীদের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আস্থা তৈরি করা যায়। এই প্রযুক্তি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর দুই পক্ষই একই প্রশ্ন করছে, তা হলো মেশিন যখন প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবদক্ষতা কোনগুলো।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি এবং তার সহকর্মীরা সম্প্রতি দুটি জরিপ করেছেন। প্রথম জরিপটির নাম ছিল ‘ডেটা ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড এআই রেডিনেস সার্ভে’। এই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে পাঁচশ কোম্পানির কাছে প্রশ্ন করা হয়। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, তারা কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছেন এবং তারা এতে কতটা বিনিয়োগ করছেন।
দ্বিতীয় জরিপটির নাম ছিল ‘কলেজ হায়ারিং আউটলুক সার্ভে’। এতে চারশ ৭০ জন নিয়োগদাতাকে প্রশ্ন করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় তারা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেন। এ ছাড়াও জিজ্ঞাসা করা হয় প্রশিক্ষণ ও এআই-সম্পর্কিত দক্ষতা মূল্যায়নের সময় তাদের কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়।
এআই এখন সবজায়গায়, মানুষ কি সত্যিই প্রস্তুত?
জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকেরও বেশি কোম্পানি বলছে, এখন তাদের প্রতিদিনকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এর বিপরীতে, মাত্র ৩৮ শতাংশ কোম্পানি মনে করে তাদের কর্মীরা এআই ব্যবহারে পুরোপুরি প্রস্তুত। এই ব্যবধানই বর্তমান চাকরির বাজারকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে। এআই কেবল কর্মী প্রতিস্থাপন করছে না বরং দেখিয়ে দিচ্ছে কারা এ প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রস্তুত।
বহু কোম্পানি এখন নিজেদের কাজের জন্য এআইয়ের ওপর নির্ভর হলেও মাত্র ২৭ শতাংশ নিয়োগকারী বলেছেন, যখন কোনো প্রার্থী জীবনবৃত্তান্ত লেখার বা বেতনের তথ্য খোঁজার মত কাজে এআই ব্যবহার করেন তখন তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্বাস করে যেসব এআই টুল ব্যবহার করছে, সেই একই টুল চাকরিপ্রার্থীরা নিজের ক্যারিয়ার উন্নয়নে ব্যবহার করলে অনেক সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এই মানসিকতা না বদলালে, দক্ষ কর্মীরাও বুঝে উঠতে পারবে না ‘দায়িত্বশীলভাবে এআই ব্যবহার’ বলতে আসলে কী বোঝায়।
‘ডেটা ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড এআই রেডিনেস সার্ভে’-এর ফলাফলে দেখা গেছে, এই প্রস্তুতির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে এমন সব পেশায় যেখানে সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে যেমন মার্কেটিং ও সেলস।
এই খাতগুলোতেই অটোমেশন দ্রুত বাড়ছে এবং প্রযুক্তি যত দ্রুত বদলাচ্ছে, অনেক কর্মী তত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারছে না। ফলে ছাঁটাইয়ের ঘটনাও বেশি ঘটছে।
একই সময়ে দেখা গেছে, অনেক নিয়োগকারী তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতার মানদণ্ড হালনাগাদ করেননি। তারা এখনো পুরনো ধাঁচের জীবনবৃত্তান্ত দেখে নিয়োগ দিচ্ছেন অথচ ভবিষ্যতের কাজের জন্য দরকার এআই ব্যবহারে দক্ষতা। সমস্যা আসলে কর্মীদের প্রতিস্থাপন নয়। সমস্যা হলো প্রযুক্তি এমন গতিতে এগোচ্ছে যে, অধিকাংশ মানুষ তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ভিত্তি: দক্ষতা আর বিশ্বাস
গবেষকরা বলছেন, পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলো ‘হিউম্যান এআই ফ্লুয়েন্সি’। এর মানে স্মার্ট প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করতে পারা, তার দেওয়া ফল নিয়ে প্রশ্ন করতে পারা আর নতুন কিছু শিখতে সবসময় প্রস্তুত থাকা।
ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট লিখেছে, বিভিন্ন কোম্পানির জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে এআই ব্যবহার বাড়ানো যায়, নৈতিক ও আইনের নিয়ম মানা যায় আর এআই-কে ব্যবসার আসল লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করানো যায়। এই সমস্যা কোডিং বা প্রোগ্রামিং নয় বরং ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার বিষয়।
অধ্যাপক আনন্দরাজান বলেন, ভবিষ্যৎ সেইসব মানুষের জন্য যারা মেশিনের ফলাফলকে মানুষের কাজে লাগাতে পারবে। তিনি এটাকে বলেন ‘ডিজিটাল বাইলিঙ্গুয়ালিজম’। এর অর্থ মানুষ যেমন যুক্তি দিয়ে ভাবে মেশিনও যুক্তি দিয়ে কাজ করে এই দুই দিক বুঝে চলার সক্ষমতা।
তিনি আরও বলেন, ‘রিস্কিলিং’ বা নতুন করে শেখা তখনই ভালোভাবে কাজ করে যখন কর্মীরা শেখার সময় নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত বোধ করে। ডেটা ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড এআই রেডিনেস সার্ভের ফল অনুযায়ী, যেসব কোম্পানিতে নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও ভালো পরিচালনা আছে, তারা কর্মদক্ষতা ও উদ্ভাবনে প্রায় দ্বিগুণ উন্নতি করে।
যখন কর্মীরা তাদের বস ও সিস্টেমের ওপর বিশ্বাস রাখে তারা নতুন কিছু শেখার এমনকি ভুল থেকে শেখারও সাহস পায়। এই বিশ্বাসই প্রযুক্তিকে ভয় পাওয়ার কিছু না ভেবে শেখার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলে। এতে কর্মীরা আত্মবিশ্বাস পায় এবং পরিবর্তনের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে, যোগ করেন তিনি।
কলেজ হায়ারিং আউটলুক সার্ভের তথ্য বলছে, এখন প্রায় ৮৬ শতাংশ নিয়োগকারী তাদের কর্মীদের জন্য অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বা অনলাইন বুটক্যাম্প চালু করেছে। তবে মাত্র ৩৬ শতাংশ মনে করে এআই-সম্পর্কিত দক্ষতা নতুন চাকরিপ্রার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কোম্পানি এখনো পুরনো ধাঁচের দক্ষতা শেখাচ্ছে, যেখানে ভবিষ্যতের চাকরিতে দরকার হবে একদম নতুন ধরনের এআই-সম্পর্কিত দক্ষতা।
সবচেয়ে সফল কোম্পানিগুলো শেখাকে কাজেরই অংশ বানিয়ে ফেলেছে। তারা আসল কাজের মধ্যেই শেখার সুযোগ দেয় এবং কর্মীদের নতুন কিছু চেষ্টা করতে উৎসাহিত করে।
অধ্যাপক আনন্দরাজান বলেন, ‘লক্ষ্য শুধু এআই ব্যবহার শেখানো নয় বরং এমনভাবে শেখানো যাতে মানুষ এআইয়ের সঙ্গে চিন্তা করতে পারে।’
তার মতে, এভাবেই বিশ্বাস হয় উন্নতির মূল ভিত্তি আর নতুন করে শেখানো কর্মীদের ধরে রাখার সবচেয়ে বড় উপায় হয়ে ওঠে
নিয়োগের নতুন ধারা
অধ্যাপক আনন্দরাজানের মতে, এআই ব্যবহারে এগিয়ে থাকা কোম্পানিগুলো শুধু চাকরি কমাচ্ছে না বরং চাকরির ধরন পুরোপুরি বদলাচ্ছে। তার মতে, সফল হতে হলে কোম্পানিগুলোকে এমন মানব কর্মী নিতে হবে যারা প্রযুক্তি এবং ভালো বিচারবুদ্ধি একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। এআই যেটা দেখাচ্ছে তা প্রশ্ন করতে পারে, স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে এবং তা ব্যবসায় কাজে লাগাতে পারে।
যেসব কোম্পানি এআই সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করছে তারা এখন নিয়োগের জন্য শুধু জীবনবৃত্তান্তের ওপর নির্ভর করছে না। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ কৌতূহল, বিচারবুদ্ধি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য কীভাবে বুদ্ধিমান সরঞ্জামের সঙ্গে ব্যবহার করছে।
অধ্যাপক আনন্দরাজানের মতে, এই পরিবর্তন নতুন হাইব্রিড চাকরি তৈরি করছে। যেমন ‘এআই ট্রান্সলেটর’, যারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এআই ওই বিষয়ে কী তথ্য দিচ্ছে তা বোঝায় এবং কীভাবে এর ওপর কাজ করতে হবে।
এ ছাড়া আরেকটি হলো ‘ডিজিটাল কোচ’, যারা টিমকে শেখায় কীভাবে বুদ্ধিমান সিস্টেমের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এই চাকরিগুলো মানুষের বিচারবুদ্ধি এবং মেশিনের বুদ্ধিমত্তাকে একসঙ্গে যোগ করে।
অধ্যাপক আনন্দরাজানের মতে, বিচারবুদ্ধি এবং মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা দুটোই থাকা হচ্ছে নতুন শক্তি। ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত দক্ষ কর্মীরাই শুধু পুরস্কৃত হবেন না বরং যারা মানবিক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবে তারাই সফল হবে।
