২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয় বুয়েট ছাত্র আবরারকে।
হতে সংগৃহিত
ছয় বছর কাটল, মায়ের এখনো ঘোর কাটে না। ছেলেটা মারা গেছে, তা মেনে নিতে পারেন না। রোকেয়া খাতুন এখনো ভাবেন, আবরার ফিরে আসবে, মা বলে ডাকবে!
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “৬টা বছর! অনেক দিন হয়ে গেল ছেলেটা নেই। কি নিষ্ঠুরভাবে তাকে খুন করেছে! যারা খুন করেছে তাদের সাজা হয়েছে, এটা যেন কার্যকর হয়। আশা করছি এই সরকার রায় কার্যকর করে মামলাটা নিষ্পত্তি করবে।”
আবরার ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট।
ওই ঘটনায় চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন আবরারের বাবা। সেই মামলার রায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আপিল বেঞ্চ এ বছর ১৬ মার্চ সেই সাজাই বহাল রাখে।
আবরারের মা রোকেয়া বলেন, “মুখে বলি ছেলেটা মারা গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি না যে আমার ছেলেটা আর আসবে না। এখনো ভাবি, আবরার ফিরে আসবে, আমাকে মা বলে ডাকবে। ওর ব্যবহৃত জিনিসগুলো কাউকে ধরতে দিই না।”
কুষ্টিয়া ছেড়ে এখন ঢাকায় থাকছেন রোকেয়া খাতুন। তার ছোট ছেলে আবরার ফায়াজ বুয়েটে পড়ছে। বুয়েট থেকে পাস করে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা তার।
“তখন তো ওকে আর কাছে পাব না। আর ওরে রেখে থাকতে কষ্ট হয়। এজন্য ঢাকায় বাসা নিয়ে ছেলের সাথে থাকছি,” বলেন রোকেয়া।
আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, “হাই কোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছেন। আশা করছি আপিল বিভাগেও হাই কোর্টের রায় বহাল থাকবে। এই সরকার রায় কার্যকর করবে।”
এ মামলায় দণ্ডিত ২৫ আসামির মধ্যে চারজন এখনো পলাতক। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান বরকত উল্লাহ।
তিনি বলেন, “ছয় বছর ধরে মামলার পিছে দৌড়াচ্ছি। জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। রায়টা কার্যকর হলেও শান্তি পেতাম।”

কী ঘটেছিল?
এ মামলার আসামিদের সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে আটজন আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আবরারকে কীভাবে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে আসে তাদের জবানবন্দিতে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায় কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবরার ফেইসবুকে তার শেষ পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন। বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই যে ফেইসবুক পোস্টের সূত্র ধরে ‘শিবির সন্দেহে’ আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা সংগঠনটির তদন্তে উঠে এলে ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়।
আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন।
তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোতে নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আবরার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. অনিক সরকার, উপ-সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, শিক্ষার্থী মো. মুজাহিদুর রহমান ও এএসএম নাজমুস সাদাত, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, মুনতাসির আল জেমি, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শাসছুল আরেফিন রাফাত, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু, বুয়েটের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের ১৭ তম ব্যাচের ছাত্র মুহাম্মাদ মোর্শেদ-উজ-জামান মন্ডল ওরফে জিসান, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭ তম ব্যাচের ছাত্র এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬ তম ব্যাচের ছাত্র মুজতবা রাফিদ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তরা হলেন–বুয়েট ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আকাশ হোসেন ও মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, “হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে আসামিপক্ষ থেকে ১৫টি সাবমিশন তুলে ধরা হয়। মোর্শেদ অমত্য ইসলামের পক্ষে আমি ছয়টি সাবমিশন তুলে ধরি। কিন্তু বিষয়গুলো আলোচনা করে খণ্ডন করা হয়নি। আপিলে বিভাগে আমরা এসব তুলে ধরব।”
তিনি বলেন, “মামলা জটের কারণে আপিল শুনানি হচ্ছে না। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো নেগলিজেন্স নাই। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে যুক্তি তুলে ধরব। আশা করছি, আমরা ন্যায়বিচার পাব।”