বাচ্চুর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সহকর্মী ফোয়াদ নাসের স্মরণ করলেন তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সংগীত যাত্রা এবং মানবিক গুণের কথা।
সংগৃহিত
পৃথিবীর মায়া কাটানোর সঙ্গে ভক্ত-সহশিল্পীদের সব ভালোলাগাই যেন সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ডদল এলআরবির এই জাদুকরী গিটারিস্ট-কণ্ঠশিল্পীকে হারিয়ে এখনো খুঁজে ফেরেন অনেকেই।
প্রতিবছর তার মৃত্যুর দিনটিই শুধু নয়, আইয়ুব বাচ্চু সবসময়ই মনের ‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডের ফোয়াদ নাসেরের মনের গভীরেই থাকেন। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর বাচ্চু পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
শুধু বাচ্চুর গান, সুর, গিটারে সুরের মুর্ছনা, এসবই তাকে মুগ্ধ করত তাই নয়। আরেকটি কারণে ফোয়াদ নাসের ছিলেন প্রয়াত এই শিল্পীর ‘গুণমুগ্ধ’, আর সেটি হচ্ছে তার গোপনে অন্যকে সহযোগিতার করার চেষ্টা।
এই সংগীত পরিচালককে আইযুব বাচ্চু ডাকতেন ‘বব’ নামে ডাকতেন, আর তিনি বাচ্চুকে ডাকতেন ‘ব্যাক্কাস’ বলে।
বাংলা রকের কিংবদন্তি ও ‘এলআরবি’ ব্যান্ডের গিটারিস্ট ও গায়ক আইয়ুব বাচ্চু নেই সাত বছর। বাচ্চুর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সহকর্মী ফোয়াদ নাসের গ্লিটজের কাছে স্মরণ করলেন তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সংগীত যাত্রা এবং মানবিক গুণের কথা।
গ্লিটজকে তিনি বলেন, “বাচ্চুকে গিটার জাদুকর, গায়ক, সুরকার যে নামেই আখ্যায়িত করি না কেন, আইয়ুব বাচ্চু আমার কাছে নির্ভেজাল প্রাণের বন্ধু, সংগীত সহযোদ্ধা। আশির দশকের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সফরে গেলে অন্যরকম অজানা আবেগ কাজ করত। বাচ্চুর সঙ্গে গল্প ও গানের আড্ডায় সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যেত। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল সমকালীন পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও বিভিন্ন গানের কর্ড নিয়ে।”
আজম খান অসুস্থ হওয়ার খবরে এক স্মরণীয় ঘটনা মনে করে ফোয়াদ নাসের বলেন, “বাচ্চু তখন একের পর এক কালজয়ী গান সৃষ্টি করে শ্রোতাদের ভালোবাসা ও ভক্তদের আশীর্বাদের অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আজম ভাইয়ের অসুস্থতার খবর আমরা সবাই পেয়েছিলাম। এই খবর পাওয়ার ঠিক পরের দিন খুব সকালে বাচ্চু আমাকে ফোন করে বলল ‘বব রেডি হন’, আমি প্রশ্ন করলাম ‘কেন ব্যাক্কাস?’ উত্তরে সে আমাকে বলল, ‘তহবিল সংগ্রহ করতে যেতে হবে’।
“আমাকে সাথে নিয়ে বাচ্চু বের হলেন। বিভিন্ন চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত আমরা তহবিল সংগ্রহ করি। সেই প্রাপ্ত সংগ্রহের পরিমাণ যা দাঁড়াল তাতে আজম ভাইয়ের চিকিৎসা ব্যয় অনেকখানি নিশ্চিত হল।”
মানবিক গুণের কথা উল্লেখ করে ফোয়াদ নাসের বলেন, “এদেশের অনেক সঙ্গীতশিল্পীই তার সাহায্য সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাচ্চু অনেক অনেক মানুষকে গোপনে নিয়মিত আর্থিকভাবেও সহয়তা করত। বাচ্চু অসম্ভব মানবিক মমত্ববোধ নিয়ে নীরবে মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল শ্রদ্ধার সাথে।”
অনেকটাই অভিমানি ছিলেন বাচ্চু। তবে সেই অভিমান মনে ধরে বসে থাকতেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই মান নিজেই ভাঙতেন।
সেই গল্প বললেন সংগীত পরিচালক ফোয়াদ নাসের।
“বাচ্চুর অভিমান করার পরিমাণ একটু বেশিই ছিল। একবার মাইলসের সাথে ঢাকা স্টেডিয়ামের একটা অনুষ্ঠান নিয়ে বাচ্চুর সঙ্গে বড় আকারের ভুল বোঝাবুঝি হয় আমাদের। আমি আর পার্থ বড়ুয়া (সোলস ব্যান্ডের গায়ক) উদ্যোগ নেই তার অভিমান প্রশমনের। তবে আমরা খুব সফল হতে পারিনি। বাচ্চু রাগ করেছিল। কয়েক দিন পর বামবার (বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন) একটা সভা চলাকালীন হঠাৎ অতর্কিত হামলা করার মত করে সদলবলে হলে প্রবেশ করল বাচ্চু, মুহূর্তে মধ্যেই সভাটি এক পার্টির রুপ নিল। বাচ্চু এমন সহজ সরল মনের মানুষ ছিল।”
বাচ্চুর সঙ্গে ফোয়াদ নাসের শেষবার মঞ্চে পারফর্ম করেছিলেন ‘সাউন্ড অফ সাইলেন্স’ নামের এক যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনায়।
বাচ্চুর প্রতিভা বিকাশ ঠিকভাবে হয়নি, এমন আক্ষেপও আছে তার মধ্যে।
ফোয়াদ নাসের বলেন, “বাচ্চু এমন এক প্রতিভাবান শিল্পী ছিল যে রেডিও, টেলিভিশন এবং মূলধারার চলচ্চিত্রে অনেক কাজ করতে পারত। তার মগজে সবসময় মেজাজের সুর খেলা করত। আমার মনে হয় আমরা তাকে এই প্রতিভা প্রকাশের জায়গা থেকে তাকে বঞ্চিত করেছি। শুধু ‘সাগরিকা’ সিনেমা বা ‘আম্মাজান’ সিনেমার গানে বাচ্চুকে আমরা পেয়েছি। তাকে দিয়ে আরও অনেক চলচ্চিত্রের গান করানো যেত।”
আড়াই দশকের বেশি সময়ে ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘বারো মাস’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’, ‘এক আকশের তারা তুই’র মত বহু গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন বাচ্চু।
মৃত্যুর দিনের কথা স্মরণ করে শিল্পী ফোয়াদ নাসের বলেন, “বাচ্চুর মৃত্যু মেনে নিতে পারিনি। হাজার হাজার দর্শক আর গিটার হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চু আর নেই, সেই খবরের বাস্তবতা মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে। বাচ্চু সবসময় আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে। আমরা তাকে সেভাবেই স্মরণে রাখব।”
দীর্ঘ সংগীত জীবনে আইয়ুব বাচ্চুর রয়েছে ‘ফেরারি মন’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘হকার’, ‘অচেনা জীবনে’, ‘মনে আছে নাকি নাই’, ‘স্বপ্ন’, ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘মন চাইলে মন পাবে’ এর মত জনপ্রিয় সব অ্যালবাম। তার শেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।
