২০৩০ সালে স্টেশনটি অবসর নিলেও পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে নিজেদের উপস্থিতি ছাড়ছে না নাসা ও তার আন্তর্জাতিক অংশীদাররা। বিকল্প পথ খুঁজছে তারা।
হতে সংগৃহীত
২০৩০ সালে বিদায় নেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস এবং নতুন যুগের সূচনা করবে বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন।
২০০০ সালের নভেম্বর থেকে এখনও পর্যন্ত অবিরামভাবে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে মানুষের উপস্থিতির ধারা ধরে রেখেছে নাসা ও সংস্থাটির আন্তর্জাতিক অংশীদাররা, যেখানে সব সময় অন্তত একজন হলেও মার্কিন নভোচারী রয়েছেন। তাদের এ অব্যাহত যাত্রা খুব শিগগিরই ২৫ বছর পূর্ণ করবে।
মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে হয়ত মানবজাতির অন্যতম অসাধারণ সাফল্য আইএসএস, যা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে মহাকাশে সহযোগিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু সব ভালো জিনিসেরই শেষ থাকে।
২০৩০ সালে আইএসএসকে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী ও নির্জন এক স্থানে ফেলা হবে, যেখানে এর ফলে মানুষ বা বাস্তুতন্ত্রের কোনো ক্ষতি হবে না। এ প্রক্রিয়াটিকে বলে ‘ডিঅরবিট’ বা কক্ষপথ থেকে নামানো।
১৯৯৮ সালে আইএসএসে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন অংশ উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে স্টেশনটি, যার মধ্যে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, জীবপ্রযুক্তি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাজাগতিক পদার্থবিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান এবং আরও অনেক বিষয়।
স্টেশনের ভেতরে গবেষণা চালান গবেষকরা এবং স্টেশনের বাইরে সংযোগওয়ালা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পরীক্ষা থেকে তাদের বহু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে স্বীকৃত নানা বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে।
এসব গবেষণার কিছু বজ্রপাত সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে উন্নত করেছে, ক্যান্সার প্রতিরোধী গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের স্ফটিকায়নের প্রক্রিয়াকেও করেছে উন্নত। মহাকাশে কৃত্রিম রেটিনা কীভাবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়েও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে এসব গবেষণা, এমনকি অপটিক্যাল ফাইবারের প্রক্রিয়াকরণ এবং কক্ষপথে কীভাবে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা যায় তারও ব্যাখ্যা মিলেছে এসব গবেষণায়।
সব মিলিয়ে, আইএসএস চার হাজারের বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, যার ফলে ৪ হাজার ৪০০টির বেশি গবেষণা প্রকাশনা হয়েছে, যা পৃথিবীতে জীবন উন্নত করতে ও ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণার নতুন পথ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

২০৩০ সালে আইএসএসকে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী ও নির্জন এক স্থানে ফেলা হবে। ছবি: রয়টার্স
কক্ষপথে মানুষের অবস্থান অব্যাহত রাখা
২০৩০ সালে স্টেশনটি অবসর নিলেও পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে নিজেদের উপস্থিতি ছাড়ছে না নাসা ও তার আন্তর্জাতিক অংশীদাররা।
পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে গবেষণার সুযোগটি অব্যাহত রাখতে বিকল্প পথ খুঁজছে নাসা। যাতে পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০২ কিলোমিটার উপরে ২৫ বছর ধরে চলমান মানুষের অবিরত উপস্থিতির বিষয়টি আরও দীর্ঘায়িত করা যায়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনটি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে নাসা, যার মাধ্যমে নিজেদের মালিকানাধীন ও বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে সাহায্য পাবে বিভিন্ন কোম্পানি। এসব স্টেশন বসানো হবে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে।
বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্যিক অংশীদারদের মাধ্যমে আইএসএসে সরবরাহ পাঠাতে সফল হয়েছে নাসা। সম্প্রতি ইলন মাস্কের মহাকাশ কোম্পানি স্পেসএক্স ও মার্কিন প্লেন নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি করেছে সংস্থাটি, যাতে ড্রাগন ও স্টারলাইনার মহাকাশযানের মাধ্যমে নভোচারীদের মহাকাশে পাঠানো যায়।
এসব কর্মসূচির সাফল্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনের উন্নয়ন উৎসাহিত করতে ৪০ কোটিরও বেশি ডলার বিনিয়োগ করেছে নাসা, যাতে আইএসএস অবসর নেওয়ার আগেই এসব নতুন স্টেশন উৎক্ষেপণ ও চালু করা যায়।
বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনের নতুন যুগের সূচনা
চলতি মাসেই বাণিজ্যিক বিভিন্ন মহাকাশ স্টেশনের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশীদারিত্ব প্রস্তাব করে একটি খসড়া ঘোষণা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
যেসব কোম্পানি নাসার বাছাইয়ে নির্বাচিত হবে তারা নিজেদের মহাকাশ স্টেশনের নকশা ভালোভাবে তৈরি ও যাচাইয়ের জন্য অর্থ পাবে। তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে, তাদের তৈরি করা স্টেশনে অন্তত চার জন মানুষ টানা ৩০ দিন পৃথিবীর কক্ষপথে থাকতে পারবেন।
এরপরের ধাপে নাসা এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত নকশা অনুমোদন ও সার্টিফিকেশনের দিকে, যেখানে এসব বাণিজ্যিক স্টেশনকে নাসার কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ করতে হবে। ফলে এসব স্টেশনের ওপর নির্ভর করে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন মিশন ও পরিষেবা কিনবে সংস্থাটি। যেমনটি বর্তমানে নাসা আইএসএসে কার্গো ও নভোচারী পাঠাতে স্পেসএক্স বা অন্যান্য বাণিজ্যিক কোম্পানির সাহায্য নিয়ে করে বিষয়টি তেমনই।
এসব দলের মধ্যে কে বা কারা কখন সফল হবে তা এখনও নিশ্চিত নয়, সময়ই তা বলে দেবে।
এসব নতুন স্টেশন নির্মাণ কালে নিজেদের ‘তিয়াংগং’ মহাকাশ স্টেশনে বসবাস ও কাজ চালিয়ে যাবেন চীনের নভোচারীরা। এ স্টেশনটিতে তিনজন নভোচারী একসঙ্গে থাকতে পারেন, এখানে সব সময় কেউ না কেউ থাকেন এবং এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০২ কিমি ওপরে রয়েছে।
আইএসএসে মানুষের অবিরত অবস্থানের ধারাটি শেষ হয়ে গেলেও চীন এবং তাদের তিয়াংগং মহাকাশ স্টেশনই হবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে টানা সক্রিয় মহাকাশ স্টেশন। এরইমধ্যে তিয়াংগং-এ প্রায় চার বছর ধরে টানা অবস্থান করছেন নভোচারীরা, যা এখনও চলমান।
এসব নতুন বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনের পৃথিবীকে আবর্তণ করতে গিয়ে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার গতি তুলতে কয়েক বছর সময় লাগবে। একইসঙ্গে ২০৩০ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনতেও এখনও কয়েক বছর বাকি।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা কল্পনাও করতে পারেননি যে, একদিন রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম বস্তুর একটি মানুষেরই মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভাবিত ও মানুষের হাতে তৈরি হবে।