ইএসএ-এর ‘ক্রায়োস্যাট’ স্যাটেলাইটের এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করা তথ্য ব্যবহার করে আবিষ্কারটি সম্ভব হয়েছে।
হতে সংগৃহিত
অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের নিচে লুকিয়ে রয়েছে রহস্যময় এক হ্রদের জগৎ, যেখানে ৮৫টি লুকানো হ্রদের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
এসব ‘সাবগ্লাসিয়াল লেক’ পৃথিবীর পৃষ্ঠের কয়েক কিলোমিটার নিচে অবস্থান করছে এবং বরফের চাদর যেভাবে চলাচল করছে তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে হিমবাহের স্থিতিশীলতা ও গোটা বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ওপর।
এখন স্যাটেলাইট তথ্যের সাহায্যে বরফে ঢাকা অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের নিচে আরও ৮৫টি নতুন হ্রদের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে বর্তমানে পরিচিত সক্রিয় হ্রদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুইশো ৩১টি।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইএসএ-এর ‘ক্রায়োস্যাট’ স্যাটেলাইটের এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করা তথ্য ব্যবহার করে আবিষ্কারটি সম্ভব হয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
বর্তমানে পরিচিত সক্রিয় হ্রদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুইশো ৩১টি। ছবি: গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া
মেরু অঞ্চলের সাগরের বরফের পুরুত্ব পরিমাপ এবং অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রীনল্যান্ডের বিশাল বরফের চাদরের উচ্চতার পরিবর্তনও পর্যবেক্ষণ করেছে ২০১০ সালে উৎক্ষেপিত ‘ক্রায়োস্যাট’ স্যাটেলাইটটি।
এর রেডার যন্ত্রটি এতটাই সংবেদনশীল যে, বরফের পৃষ্ঠের সামান্য ওঠানামাও শনাক্ত করতে পারে এটি, যা থেকে ইঙ্গিত মেলে, বরফের অনেক নিচে যেসব হ্রদ রয়েছে, সেগুলোর ভেতরে কখন পানি জমছে বা কখন সেখান থেকে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে।
‘সাবগ্লাসিয়াল লেক’ স্থির বা এক জায়গায় আটকে থাকা পানির ভাণ্ডার নয়। এদের মধ্যে কিছু ‘সক্রিয়’ হ্রদ রয়েছে। ফলে এসব হ্রদে নিয়মিতভাবে পানি খালি হয় এবং আবার ভর্তি হয়। আর এ পুরো চক্রটি শেষ হতে কয়েক মাস বা কখনও কখনও কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
এসব পরিবর্তনের কারণে বরফের ওপরের অংশ কয়েক মিটার পর্যন্ত নিচে দেবে যায় বা উপরে উঠে আসে। আর ক্রায়োসেটের মতো স্যাটেলাইটগুলো এসব ওঠানামা শনাক্ত করতে পারে।
এ গবেষণার আগে, গোটা বিশ্বে কেবল ৩৬টি পূর্ণাঙ্গ পানি নিষ্কাশন চক্র পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ। এ নতুন গবেষণায় আরও ১২টি পূর্ণাঙ্গ পানি নিষ্কাশন চক্র রেকর্ড করেছেন গবেষকরা। ফলে মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮টি।
এ গবেষণার প্রধান লেখক ও ‘ইউনিভার্সিটি অফ লিডস’-এর পিএইচডি গবেষক স্যালি উইলসন বলেছেন, এসব পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা খুবই কঠিন। কারণ এসব হ্রদ শত শত মিটার বরফের নিচে লুকিয়ে থাকে।
“এমন অবস্থায় সাবগ্লাসিয়াল হ্রদের পানি ভরা ও খালি হওয়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত কঠিন, বিশেষ করে এ প্রক্রিয়াটি শেষ হতে কয়েক মাস বা এমনকি বছর পর্যন্ত সময় লাগে।” তবে নতুন স্যাটেলাইট তথ্যের সাহায্যে ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার এমক পরিবর্তনকে নজরে রাখতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণায় বরফের নিচে নতুন পানি নিষ্কাশনের পথও চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা, যার মধ্যে পাঁচটি রয়েছে সংযোগওয়ালা হ্রদের জাল।
এ গবেষণার সহ-লেখক ও ‘ইউনিভার্সিটি অফ লিডস’-এর অধ্যাপক আন্না হগ বলেছেন, এসব আবিষ্কার থেকে ইঙ্গিত মেলে, অ্যান্টার্কটিকার লুকানো পানি ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি গতিশীল।
তিনি বলেছেন, “সাবগ্লাসিয়াল হ্রদের অঞ্চল বিভিন্ন পানি ভর্তি বা নিষ্কাশন চক্রের সময় পরিবর্তিত হতে পারে– এমনটি জানতে পেরে খুবই দারুণ লাগল।”
গবেষকরা বলছেন, এসব হ্রদকে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এরা নির্ধারণ করতে পারে হিমবাহ কত দ্রুত সমুদ্রের দিকে সরবে। বরফের চাদরের নিচে গরম পৃথিবীর তাপ ও বরফের নিচের পাথরের ওপর ঘর্ষণের কারণে পানির গলে যাওয়া বা ‘মেলটওয়াটার’-এর তৈরি হয়।
এ পানি জমে হ্রদের তৈরি করতে পারে, যা মাঝেমধ্যে নিষ্কাশিত হয়। এ কারণে ঘর্ষণ কমে যায় ও বরফের উপরের স্তর দ্রুত সরতে পারে। এ প্রক্রিয়াটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ওপর বড় ধরনের প্রভাবও ফেলতে পারে।
সব হ্রদই সক্রিয় নয়। যেমন– ‘লেক ভোস্টক’ নামের হ্রদটি চার কিলোমিটার পুরু বরফের নিচে চাপা ও এর পানির পরিমাণ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের থেকেও বেশি। এটিকে স্থিতিশীল বলে অনুমান করা হয়।
তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, ভবিষ্যতে ভোস্টকের মতো কোনো বিশাল হ্রদ খালি হয়ে গেলে তা সমুদ্র স্রোত, সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র ও বরফের চাদরের স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে গবেষণাটি। ইএসএর-এর ‘পোলার সায়েন্স ক্লাস্টার’-এর কোঅর্ডিনেটর মার্টিন ওয়্যারিং বলেছেন, “আমরা যত বেশি অ্যান্টার্কটিক বরফের চাদরের জটিল বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যেমন– এর নিচে গলিত পানির প্রবাহ সম্পর্কে বুঝতে পারব তত বেশি সঠিকভাবে ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কতটা বৃদ্ধি পাবে তা অনুমান করতে পারব।”
গবেষকদের জন্য এখন পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার লুকানো বিভিন্ন হ্রদে গিয়ে সরাসরি গবেষণার বিষয়টি নাগালের বাইরেই রয়ে গিয়েছে।
তবে স্যাটেলাইটের সাহায্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফের চাদরের নিচে পানির এ গোপন জগৎকে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছেন বিজ্ঞানীরা এবং পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য এর কী মানে হতে পারে তা-ও জানার চেষ্টা করছেন তারা।