মাকড়সার ভবিষ্যদ্বাণী থেকে গ্রন্থপাঠ
হতে সংগৃহিত
ভবিষ্যৎ! এক অজানা পথ, যার বাঁকে কী আছে তা জানতে মানুষের কৌতূহল চিরন্তন। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে পথ খুঁজতে গিয়ে মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই নির্ভর করেছে নানা রকম ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বোডলিয়ান লাইব্রেরিতে ‘ওরাকেলস, ওমেনস অ্যান্ড আনসারস’ শীর্ষক এক প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বজুড়ে ভবিষ্যৎ জানার এমনই কিছু বিচিত্র আর চমকপ্রদ পদ্ধতি।
নৃবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কেবল অতীতেরই নয়, বিভিন্ন সংস্কৃতির গভীর ভয় আর উদ্বেগও তুলে ধরে, যা আজও আমাদের সমাজে প্রাসঙ্গিক। চলুন, জেনে নেওয়া যাক এমনই পাঁচটি প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণী পদ্ধতি সম্পর্কে:
১. মাকড়সার ভবিষ্যদ্বাণী: ক্যামেরুনের রহস্যময় জগৎ
ক্যামেরুনের মাম্বিলা সংস্কৃতিতে ভবিষ্যৎ জানার এক অদ্ভুত উপায় হলো মাকড়সা বা কাঁকড়ার সাহায্য নেওয়া। এই পদ্ধতিকে তারা বলে ‘নাংগাম ডু’। সাধারণত হ্যাঁ বা না-সূচক প্রশ্ন করা হয়।
পদ্ধতিটি বেশ অভিনব। একটি ভাঙা মাটির পাত্র দিয়ে মাকড়সা বা কাঁকড়ার গর্ত ঢেকে দেওয়া হয়। তারপর গর্তের চারপাশে রাখা হয় একটি লাঠি, একটি পাথর এবং পাতা দিয়ে তৈরি কিছু তাস। লাঠি ‘হ্যাঁ’ এবং পাথর ‘না’ বোঝায়, আর পাতার তাসগুলোতে খোদাই করা থাকে কিছু বিশেষ চিহ্ন যা অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দেয়। ডিভাইনর (গণৎকার, জ্যোতিষী, ওঝা বা পুরোহিত) গর্তে টোকা দিয়ে মাকড়সা বা কাঁকড়াকে বাইরে আসার জন্য উৎসাহিত করেন।
একজন ক্যামেরুনীয় কাঁকড়ার মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় বিভিন্ন বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করছেন, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।
মাকড়সা বা কাঁকড়ার চলাচলের কারণে এই বস্তুগুলো স্থান পরিবর্তন করে। যদি কোনো পাতার তাস লাঠি বা পাথরের কাছে চলে যায়, তাহলে প্রশ্নকর্তা তার উত্তর পেয়ে যান। তবে, উত্তর সবসময় স্পষ্ট হয় না। যদি লাঠি বা পাথর কোনটিই নির্বাচিত না হয় (বা উভয়ই নির্বাচিত হয়), তখন ডিভাইনর এবং প্রশ্নকর্তাকে নিজেদের বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা খুঁজে নিতে হয়, অথবা তারা ধরে নেন যে মাকড়সা এক্ষেত্রে কোনো উত্তর দেয়নি!
২. হাতের রেখা: ভাগ্য পড়ার প্রাচীন শিল্প
হাতের রেখা দেখে ভবিষ্যৎ বলা, যা ‘পামিস্ট্রি’ নামে পরিচিত, তা কেবল মেলায় দেখা বিনোদন নয়, বিশ্বের অনেক সংস্কৃতিতে এর গভীর গুরুত্ব রয়েছে। হাতের রেখা, আকার এবং বিশেষ চিহ্ন দেখে মানুষের চরিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। প্রাচীন এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন সভ্যতা এই পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিল।
কিছু সংস্কৃতিতে হাতের তালুর রেখার গভীরতা ও বিন্যাসকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। আবার অনেকে হাত ও আঙুলের আকারকেও গুরুত্ব দেন। ভারতের কিছু ঐতিহ্যে তালুতে থাকা বিশেষ চিহ্ন ও প্রতীকগুলিও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহন করে। উনিশ শতকে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় পামিস্ট্রি নতুন করে জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে যখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ আবিষ্কার হয়। তখন মানুষ ভাবত, যদি ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে মানুষকে শনাক্ত করা যায়, তাহলে হাতের রেখা দেখে তাদের ব্যক্তিত্বও বোঝা যাবে।
অস্কার ওয়াইল্ডের হাতের তালু, ছবি: হাউটন লাইব্রেরি।
বিখ্যাত আইরিশ কবি অস্কার ওয়াইল্ডের হাত দেখেছিলেন অ্যাডওয়ার্ড হেরন-অ্যালেন। তিনি ওয়াইল্ডের হাতের রেখা দেখে মন্তব্য করেছিলেন যে, তার হাতে ‘অসাধারণ মস্তিষ্কের ক্ষমতা’ এবং ‘প্রকাশের মহান শক্তি’ রয়েছে।
৩. গ্রন্থপাঠ: বইয়ের পাতায় ভবিষ্যতের ইশারা
যদি কোনো কঠিন প্রশ্নের দ্রুত উত্তর পেতে চান, তাহলে গ্রন্থপাঠ বা বিলিওম্যান্সি আপনার জন্য একটি সহজ উপায় হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বই ব্যবহার করে এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হতো।
ইউরোপে হোমার বা ভার্জিলের মহাকাব্য, ইরানে হাফিজের কবিতার সংকলন ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ ব্যবহার করা হতো। খ্রিস্টান, মুসলিম এবং ইহুদিদের মধ্যে ধর্মগ্রন্থগুলোও প্রায়শই ব্যবহৃত হয়েছে, যদিও এটি নিয়ে বিতর্কও ছিল।
এই পদ্ধতির কয়েকটি উপায় আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বইয়ের পাতার মধ্য দিয়ে একটি ধারালো বস্তু ঠেলে দেখা হয়, এর ডগা কোথায় পৌঁছায়। আরেকটি পদ্ধতি হলো, এলোমেলোভাবে একটি পৃষ্ঠা খুলে চোখ বন্ধ করে যেখানে দৃষ্টি পড়ে সেই অংশটি পড়া। যদিও এর জন্য সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়, তবে বিশ্বাস করা হয় যে এই পাঠ্যাংশটি আপনার সংকট বা জিজ্ঞাসার উত্তর বহন করে।
হাফিজের দিওয়ানের একটি পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠা, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।
৪. জ্যোতিষশাস্ত্র: নক্ষত্রদের বার্তাবাহক
জ্যোতিষশাস্ত্র প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতেই বিদ্যমান। প্রাচীন ব্যাবিলন থেকেই জ্যোতিষীরা আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন। জন্মকুণ্ডলী তৈরি করতে, যা মূলত পৃথিবী থেকে দেখা গ্রহ ও নক্ষত্রের একটি নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের মানচিত্র, জ্যোতিষীদের নির্ভুল জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্যের প্রয়োজন হতো। একারণেই প্রাক-আধুনিক যুগে জ্যোতিষশাস্ত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল।
জ্যোতিষীরা একজন ব্যক্তির জন্ম মুহূর্তের জন্য, বা যখন কোনো আগ্রহী প্রশ্ন করেন সেই মুহূর্তের জন্য, এমনকি ভবিষ্যতের একটি নির্দিষ্ট তারিখের জন্য কুণ্ডলী তৈরি করতে পারতেন, যাতে কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার জন্য সঠিক সময় নির্ধারণ করা যায়। প্রতিটি গ্রহ এবং রাশিচক্রের নিজস্ব অর্থ রয়েছে, যা কুণ্ডলীতে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে আরও জোরালো হয়।
জ্যোতিষীদের এই চার্টগুলি পড়ে মানুষ দীর্ঘকাল ধরে জীবনের নানা ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা পেয়ে আসছে, যা কঠিন প্রশ্নের উত্তর পেতে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অনেক প্রাচীন সংস্কৃতিতে, জ্যোতিষীরা রাজদরবারে এবং সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকতেন। তারা রাজ্যের স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতেন।
হাফিজের দিওয়ানের একটি পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠা, ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।
৫. পঞ্জিকা ভিত্তিক ভবিষ্যদ্বাণী: দিনলিপির পাতায় ভবিষ্যৎ
পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার দীর্ঘকাল ধরে ভবিষ্যদ্বাণী এবং বিভিন্ন কাজ করার সেরা সময় নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আজও অনেক দেশে পঞ্জিকায় চুল কাটা থেকে শুরু করে নতুন ব্যবসা শুরু করার মতো বিভিন্ন কাজের জন্য শুভ ও অশুভ দিনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ‘পাওয়ুকন’ নামক বালিনিজ হিন্দু পঞ্জিকা ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে বিভিন্ন সপ্তাহ বিভিন্ন স্থানীয় দেব-দেবী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই দেব-দেবীদের বৈশিষ্ট্য অনুসারে কিছু সপ্তাহ বিবাহ অনুষ্ঠানের মতো কাজের জন্য অন্যদের চেয়ে ভালো বলে বিবেচিত হয়। স্প্যানিশ আগমনের আগে মেসোআমেরিকায় (আধুনিক মধ্য মেক্সিকো থেকে কোস্টারিকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল) আপনার প্রকৃতি, ভাগ্য এবং এমনকি আপনার নামও আপনি যে দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার দ্বারা নির্ধারিত হতো।
মেক্সিকোর ক্যালেন্ডার পুরোহিতরা একটি পবিত্র, ২৬০ দিনের ভবিষ্যদ্বাণী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে বিবাহের সাফল্য অনুমান করতে পারতেন। চিহ্নগুলি ব্যাখ্যা করে, পুরোহিত বলতে পারতেন যে একটি সম্পর্ক সুখী, চ্যালেঞ্জিং বা অভিশপ্ত হবে– এমনকি কতজন সন্তান হবে তাও জানাতে পারতেন।
